শারয়ী বিষয়ে মতভেদ থাকা সত্বেও সালাফগণ যেমন ছিলেন

 🪴 *_শারয়ী বিষয়ে মতভেদ থাকা সত্বেও সালাফগণ যেমন ছিলেন_*🪴

*✍🏻তাওহীদুর রহমান বিন মঈনুল হক্ব*

*[ছাত্র: জামিয়া সালাফিয়া বেনারস]* 

মুসলমানদের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ বা ওলামাদের মধ্যে পরস্পরে বিভিন্ন বিষয়ে বা শরীয়তের বিভিন্ন মাসলা- মাসায়েলে মতানৈক্য দেখা যায়। আর এই মতভেদের কারণে আস্তে আস্তে বিভিন্ন দল ও ফেরকা তৈরি হয়েছে যেটা থেকে ইসলাম বিরত থাকতে বলেছে।

মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন।

*وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا*

আর তোমরা আল্লাহর রশি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। [সূরা আলে ইমরান ১০৩] 

*إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ.*

নিশ্চয় যারা তাদের দ্বীনকে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো দায়িত্ব আপনার নয় ।[সূরা আল আনআম ১৫৯]

 

এরকম অনেক প্রমান আছে যা দ্বারা বোঝা যায় যে ঐক্যবদ্ধ ভাবে জীবন যাপন করা এবং দলাদলি হতে বিরত থাকা উচিত কিন্তু তা সত্বেও জ্ঞানীদের মধ্যে যে মতভেদ দেখা যায় সেটা হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার এর বিশেষ কতগুলো কারণ রয়েছে তবে সেগুলো এখানে বর্ণনা করা হবে না। 

জ্ঞানীদের মধ্যে যে মতানৈক্য দেখা যায় সেই মতানৈক্যের অধিকাংশই হচ্ছে ছোটখাটো বা শাখাগত বিষয়। এইসব মতভেদ সম্পূর্ণরূপে মিটিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় তবে কিছু কম করা অবশ্যই সম্ভবপর বিষয়।এই মতানৈক্য থাকা সত্বেও পরস্পরে সম্মান করা, গালমন্দ না করা, বাড়াবাড়ি ও খারাপ সমালোচনা না করাই হচ্ছে প্রকৃত মুসলিমের পরিচয়। 

আরেকটা কথা সবসময়  ভাবা উচিত যে, আমাদের মধ্যে মতবিরোধ হওয়া সত্বেও কিভাবে আমরা মিলেমিশে থাকতে পারবো।ইসলাম আমাদের এ ব্যাপারে কি শিক্ষা দিয়েছে। তাছাড়া এ বিষয়ে বিশেষ করে আলেম সমাজকে বেশি চিন্তা ভাবনা করা উচিত এবং এব্যাপারে বেশি কঠোরতা অবলম্বন না করা উচিত। 

মহান আল্লাহ তা'আলা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন :-

*أَذِلَّةٍ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى ٱلْكَٰفِرِينَ.* 

অর্থ :- তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে।[সূরা আল মায়িদাহ্ ৫৪] 

 

মুমিনের বৈশিষ্ট্য তো এটা হওয়া উচিত যে এক মুমিন অপরের প্রতি নরম ব্যবহার করবে আর কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে যেমন ছিল সাহাবায়ে কেরামগণ।

*اَشِدَّاءُ عَلَي الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ.* 

অর্থাৎ :- কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। [সূরা আল-ফাত্‌হঃ ২৯] 

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে আমাদের সমাজ নিজেদের মধ্যে সামান্য মতভেদ নিয়েও পরস্পরে এত কঠোরতা অবলম্বন করে চলেছে যতটা হয়তো অমুসলিমের সাথেও হয় না। নিজেদের মাসলাক (মতবাদ), নিজেদের মতামতকে দ্বীনের মর্যাদায় রেখে দিয়েছে। আমরা মনে করছি মাসলাকের প্রচার করছি মানে দ্বীনের প্রচার করছি ।

নিজের মাসলাকের ব্যাপারে প্রতিরোধ করছি মানে দ্বীনের ব্যাপারে প্রতিরোধ করছি। এটা আমাদের দুর্বলতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। দেখা যায় তো শরীয়তের বিভিন্ন মাসআলা মাসায়েলে তুলনামূলক ভাবে মতভেদের সংখ্যা কম রয়েছে কিন্তু এই মতভেদ পূর্ণ মাসায়েল গুলোই সবসময় বিজয়ী হয়ে থাকছে। সদা সর্বদা এই সব বিষয়ের পিছনে আমরা বেশি ছুটাছুটি করছি অথচ শরীয়তের অনেক মাসায়েল আছে যাতে কোনরকম মতপার্থক্য নেই সেই বিষয়গুলো আমাদের সামনে সেরকম ভাবে চর্চা করা হয় না। কেন এই অবস্থা যখন এতগুলো বিষয়ে ঐক্য রয়েছে? আংশিক কিছু বিষয় যাতে মতভেদ রয়েছে তবুও এই ইখতেলাফী বিষয়গুলো সব সময় প্রাধান্য পাচ্ছে এবং এটাই সব সময় আমাদের মস্তিষ্কে ও সমাজে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে।

*"আদাবুল খেলাফ"* অর্থাৎ মতভেদের আদবসমূহ এই ব্যাপারে অনেক লেখনি, প্রবন্ধ, বই ইত্যাদি লেখা হয়েছে ।এই বিষয়ের মূল ভাবার্থই হচ্ছে যে, আপনার সাথে আমার মতানৈক্য থাকতেই পারে কিন্তু এই মতভেদ থাকা সত্বেও আমরা পরস্পরে সম্মান করবো ভালোবাসা বজায় রাখবো মিলেমিশে থাকব সহযোগিতা করব পরামর্শ দিবো পরামর্শ নেব ইত্যাদি।এসব বিষয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। 

এর অনেক দৃষ্টান্ত  স্বর্ণ যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত হাদিসের পাতায় ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়।

(শাঈখ আস'আদ আ'জামী হাফিঃ[শিক্ষক জামিয়া সালাফিয়া বেনারস] এর লেখনী থেকে নেওয়া আংশিক) 

*কতিপয় উদাহরণসমূহ:*

 🔹হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এবং হযরত ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু দুজনেই সুখ্যাত সাহাবী ছিলেন।ইমাম ইবনু ক্বায়্যিম রহঃ বলছেন যে দুজনের মধ্যে একশোর অধিক বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল। চিন্তা করুন ১০০ টিরও অধিক বিষয়ে মতভেদ ছিল কিন্তু তিনারা কি পরস্পর ঝগড়া করতেন? খারাপ সমালোচনা করতেন? পরস্পরে ঘৃণা করতেন? না কখনোই না! ইনাদের জীবনীতে লেখা রয়েছে যে উমার রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর  সম্পর্কে বলতেন যে, 

*كَنِيفٌ مُلِئَ عِلْمًا ، آثَرْتُ بِهِ أَهْلَ الْقَادِسِيَّةِ. (الطبقات الكبير لإبن سعد. 2308)*

তিনি (ইবনে মাসঊদ রযিঃ) হচ্ছেন ইলমের আশ্রয়স্থল আমি উনাকে কাদেসিয়াহ্ বাসীদের কে বরণ করে দিলাম।

শত মতভেদ হওয়া সত্বেও কিভাবে তিনার জ্ঞানের প্রশংসা করছেন। অপরদিকে ইবনে মাসঊদ রযিঃ উমার রযিঃ এর মৃত্যুর পর বলতেন:-

*إِنَّ عُمَرَ كَانَ لِلْإِسْلَامِ حِصْنًا حَصِينًا ، يَدْخُلُ فِيهِ الْإِسْلَامُ وَلَا يَخْرُجُ مِنْهُ ، فَلَمَّا قُتِلَ عُمَرُ انْثَلَمَ الْحِصْنُ فَالْإِسْلَامُ يَخْرُجُ مِنْهُ ، وَلَا يَدْخُلُ فِيهِ.) مصنف إبن أبي شيبه :31355)*

উমার রযিঃ  ছিলেন ইসলামের এক অতি মজবুত দূর্গ ইসলাম তাতে প্রবেশ করলে সেখান থেকে বের হতো না। যখন তিনি শহীদ হয়ে গেলেন সেই দূর্গ ভেঙে গেল ফলে সেখান থেকে ইসলাম বেরিয়ে গেল আর তাতে প্রবেশ করল না।

এই ছিল তাদের পরস্পরে ভালোবাসা ও সম্মান। আমরা আজ কোথায়?? 

🔹যায়িদ বিন সাবিত ও আবু বাকর রযিঃ এর মতভেদ:

আবু বাকর রযিঃ সহ অনেক সাহাবার মতই ইবনু আব্বাসের মত ছিল যে, মৃত ব্যক্তির পিতার উপস্থিতিতে যেমন ভাই-বোন বঞ্চিত হয়ে যায়, ঠিক তেমনি দাদার উপস্থিতিতেও ভাই-বোন বঞ্চিত হয়ে যাবে। 

কিন্তু যায়িদ বিন সাবিত সহ অন্যান্য সাহাবার মত ছিল যে, দাদার উপস্থিতিতে ভাইয়ের অংশ রয়েছে।

একদিন ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু বলেছেন যে, আশ্চর্য ব্যাপার! যায়িদকে আল্লাহর ভয় লাগে না?পৌত্র (পোতা) কে পুত্রের স্থান দিচ্ছে কিন্তু দাদাকে পিতার স্থান দেয় না! 

তবুও দেখুন পরস্পরের ভালোবাসা ও সম্মান। একদা ইবনে আব্বাস রযিঃ যায়িদ বিন সাবিতকে আরোহণ অবস্থায় দেখলেন। তারপর ইবনু আব্বাস যায়িদ বিন সাবিতের পশুর লাগাম ধরে চলতে লাগলেন তিনাকে ছাড়তে বললেন কিন্তু তিনি বলছেন যে, ওলামা ও বড়দের সাথে   আমাদের এ ধরনের আচরণ করতে হুকুম দেওয়া হয়েছে। এবার যায়িত বিন সাবিত বললেন আপনার হাতটা আমাকে একটু দেখাবেন? সঙ্গে সঙ্গে ইবনু আব্বাস রযিঃ নিজের হাতখানা বের করে দেখান। দেখা মাত্রই যায়িত বিন সাবিত তিনার হাতে চুমু দিয়ে বলেন আমাদের নবী ﷺ এর আহলে বায়েতের সাথে এ ধরনের আচরণ করতে বলা হয়েছে।

এছাড়া যখন যায়িদ এর মৃত্যু হয় তখন ইবনে আব্বাস বলেছিলেন যে এভাবেই জ্ঞান শেষ হয়ে যাবে  অন্য বর্ণনায় রয়েছে এভাবেই শিক্ষা শেষ হয়ে যায় আজকে অনেক জ্ঞান দাফন করা হলো।

এই ছিল সাহাবা কেরামের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্মান মতভেদ থাকা সত্বেও।

সাহাবাদের এরকম অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়।

*এবার কিছু উদাহরণ আইম্মাহ্ ও মুহাদ্দিসগণের যুগ থেকে দেখা যাক:-*

🔹ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর বিখ্যাত ঘটনা:

ইমাম শাফেয়ীর বয়স ছিল ১৫ বছর। এটা ছিল তিনার ছাত্রজীবন।সে সময়ের কথা, এক ব্যক্তির সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ীকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, একটা বুলবুল পাখি সব সময় কিচিরমিচির গান করবে এই শর্তে ক্রয় করা হয়েছে কিন্তু সেটা দিনের কিছু অংশে গান করত সারাদিন করত না। তখন ইমাম মালেক উত্তরে বলেন যে সেই পাখিকে ফেরত দেওয়া বৈধ হবে। প্রশ্নকারী ফিরে গিয়ে ইমাম শাফেয়ী কে জিজ্ঞাসা করে তো ইমাম শাফেয়ী বলেন যদি দিনের বেশিক্ষণ কিচিরমিচির গান করে তবে ফেরত দেওয়ার অধিকার নেই। প্রশ্নকারী ইমাম মালেক কে এই বিষয়ে আবার চিন্তা ভাবনা করতে বলে কিন্তু তিনি বললেন এটাই আমার মত যেটা তোমাকে আমি বলেছি। প্রশ্নকারী বলেন আপনার একজন সুযোগ্য ছাত্র বলেছেন যে ফেরত দেওয়ার অধিকার নাই তখন ইমাম মালেক বললেন তাকে ডেকে নিয়ে এসো তারপর ইমাম শাফেয়ীকে উপস্থিত করা হলে তিনি ইমাম শাফেয়ীকে বলেন তুমি বলেছ যে সেটা ফেরত দেওয়ার অধিকার নাই? তিনি বলেন হ্যাঁ। সেটা তুমি কিভাবে বলছ? তখন ইমাম শাফেয়ী ফাতেমা বিনতে কায়স এর হাদীস শুনিয়ে বলেন নবী ﷺ তাকে বলেন  আবু জাহাম এমন লোক যে তার কাঁধ থেকে লাঠি নামিয়ে রাখে না আর মুয়াবিয়া গরিব মানুষ তুমি ওসামাকে বিয়ে করে নাও। তিনি এখান থেকে বোঝাতে চাইছেন যে, আবু জাহাম কাঁধ থেকে লাঠি রাখে না অর্থাৎ সব সময় সফর করে কিন্ত অনেকসময় বাড়িতেও থাকে অতএব এখান থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকাংশ সময় ধরে নিয়ে সম্পূর্ণ সময়কে বোঝাতে চেয়েছেন আর এই ধরনের তা'বীর(ব্যাখ্যা) আরবি ভাষায় বৈধ রয়েছে এর জন্য আমিও বললাম যে, দিনের অধিকাংশ সময় যদি কিচিরমিচির গান করে তো সেটা ফেরত দেওয়া ঠিক হবে না কেননা এটা সম্পূর্ণ  সময়কে ধরে নেওয়া হয়েছে। 

অবস্থা দেখুন ইমাম মালিকের ছাত্র ইমাম শাফেয়ী নিজের শিক্ষকের উত্তর অথবা মাসআলা কে খন্ডন করেছেন তবুও শিক্ষক নিজের ছাত্রের উপর অসন্তুষ্ট হলেন না বরং সেটা কবুল করে নিলেন। এটাই ছিল পরস্পরে ভালোবাসা ও সম্মান মতানৈক্য থাকা সত্বেও।

 

(আদাবুল খেলাফ এর উর্দু অনুবাদ সালীকায়ে ইখতেলাফ পৃ ৩৭) 

🔹 একদা ইমাম আহমদ বিন হাম্বল ও আলী ইবনু মাদিনীর মধ্যে কোন এক বিষয় নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয় ঐ দিন ইমাম আহমদ বিন হাম্বল এর কাছে তিনি এক আরোহীতে এসেছিলেন আরোহী থেকে নেমে সেই বিষয়ে আলোচনা শুরু হয় বর্ণনাকারী বলছেন যে, আলোচনার মধ্যে খুব উচ্চস্বরে আওয়াজ হতে শুরু করেছিল। কিন্তু আলোচনা শেষে রওনা হবার সময় ইমাম আহমাদ আলী বিন মাদিনীকে ভালোভাবে আরোহীর উপর বসালেন এবং বিদায় দিলেন। সুবহানাল্লাহ! চিন্তার বিষয় হলো যে এতো তর্কাতর্কি হওয়ার পরে পরেই এই ভালোবাসা ও সম্মান। 

*এগুলো তো ছিল সোনালীযুগের কিছু দৃষ্টান্ত। এবার দেখা যাক তার পরবর্তীযুগ তথা বিংশ শতাব্দীর কিছু উদাহরণ।* 

🔹আল্লামাহ্ সানাউল্লাহ্ আমৃতসারি ছিলেন একজন বিখ্যাত আলেম এবং অনেক বড় একজন মুনাযির (তর্কবিদ)। তিনি বিভিন্ন ফিরকা ও বিভিন্ন ধর্মের লোকের সাথে মুনাযারা করেছেন তিনার একটা বড় গুণ ছিল যে, মুনাযারা (তর্ক) শেষে তিনি বিপক্ষের লোকদের খাওয়া-দাওয়ার জন্য দাওয়াত দিতেন এবং তিনার কাছে অবস্থান করার দাওয়াত দিতেন।

🔹শাঈখুল হাদীস ইসমাইল সালাফী গুজরানওয়ালা সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, একদা হজ্বের মৌসুমে হাজ্বীগনের দল একসাথে বের হয়ে স্টেশনে পৌঁছান সেখানে খুব ভিড় ছিল, নামাজের সময় হয়ে গেল তো কিছু সংখ্যক লোক সেখানে কাতার লাগিয়ে শাঈখ ইসমাইল সাহেবকে ইমামতি করার জন্য আগে যেতে বলেন যখনই তিনি মুসাল্লায় দাঁড়াতে যাবেন পিছন থেকে আওয়াজ আসছে যে আপনার পিছনে আমাদের নামাজ হবে না যেহেতু তিনি ছিলেন সালাফী আকীদার মানুষ। তখন তিনি নিজের রুমাল কাঁধে নিয়ে পিছনে সরে গিয়ে বলেন তাহলে আপনি নামাজটা পড়িয়ে দিন সাহেব। আপনার পিছনে আমার নামাজ হয়ে যাবে। সেই লোকটি তখন খুব লজ্জিত হয়ে শাঈখের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা চাইল এবং তিনাকেই নামাজ পড়াতে বলল। যদি আমাদের মতো লোক সেই জায়গাতে হতো তাহলে কি থেকে কি হয়ে যেত! অন্ততপক্ষে এটা তো  হয়েই যেত যে, ইমাম সাহেব নিজের লোকদের নিয়ে আলাদাভাবে একটা জামাত করতেন আরেকদল আরেকটা জামাত। এভাবে দুই দলেবিভক্ত হয়ে যেত।

(শাঈখ আস'আদ আ'জামী হাফিঃ [শিক্ষক জামিয়া সালাফিয়া] এর লেখনী থেকে সংগৃহীত) 

বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত তিনজন ইসলামী পন্ডিত আল্লামাহ্ নাসিরুদ্দিন আলবানী, আল্লামাহ্ আব্দুল আযীয বিন বায, ও আল্লামাহ্ মুহাম্মাদ বিন স্বলেহ আল উসায়মীন রহঃ ইনাদের মধ্যেও অনেক বিষয়ে পরস্পরে মতবিরোধ দেখা যায়।

এমনকি এই তিনজন শাঈখকে নিয়ে একটি দুই খণ্ডের বই পর্যন্ত সংকলন করা হয়েছে বইখানার নাম হচ্ছে 

*الإيجاز في بعض ما اختلف فيه الألباني وابن عثيمين وابن باز.* 

এই বইয়ে বিভিন্ন বিষয়ে তিনজন শাঈখের পরস্পরের মতানৈক্য গুলো বর্ণনা করা হয়েছে নিজের নিজের প্রমাণসহ এবং পরিশেষে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মতকেও বর্ননা করা হয়েছে অথচ তিনারা পরস্পরে কোনদিন শত্রুতা, ঝগড়া-বিবাদ, খারাপ সমালোচনা করেননি বরং তারা একে অপরের প্রশংসা করেছেন এবং জ্ঞানের সাক্ষ্য দিয়েছেন আন্তরিকতা ও সুধারণার সহিত।তিনাদের মতভেদ পরস্পরে হিংসা-বিদ্বেষ রাখার জন্য ছিল না।

তার একটি উদাহরণ হল রুকুর পরে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বাধা নিয়ে এ বিষয়ে শাঈখ আলবানী বলছেন রুকুর পরে বুকে হাত বাধা হচ্ছে বিদআত কিন্তু শাঈখ ইবনে বায বলছেন যে এটা স্পষ্ট ভুল ফতোয়া, এটা বিদআত নয় এবং কোন আলেম আমার জানা মতে এরকম বলেননি।

তা সত্ত্বেও দেখুন শাঈখ ইবনে বায শাঈখ আলবানীর ব্যাপারে বলছেন যে আমি তিনার জ্ঞানের পরিধি ও পরিসরে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করি না তিনি হচ্ছেন সুযোগ্য আলেমদের মধ্যে একজন যোগ্য আলেম যাকে আমরা জানি এবং তিনার জন্য আমরা সাক্ষ্য দিই যে তিনি ছিলেন সুন্নতের প্রতি খুবই আগ্রহী এবং তিনি অনেক উপকারী বই রচনা করেছেন তবে অন্যান্য আলেমদের মত তিনারও কিছু বিষয়ে ভুল হয়েছে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুক। 

শাঈখ আলবানী শাঈখ ইবনে বায রহঃ এর সম্পর্কে বলছেন যে ইবনে বায হচ্ছেন এমন একজন আলেম যিনি ইসলামী দুনিয়াকে তিনি নিজের জ্ঞানের মাধ্যমে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। এই ছিল তিনাদের মধ্যে একেঅপরের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান। 

এছাড়া শাঈখ আলবানী এবং ইবনু উসাইমীন রহঃ এর মধ্যেও কিছু মতানৈক্য ছিল তার একটি উদাহরণ বলি শাঈখ আলবানী রহঃ বলছেন কিবলামুখী হয়ে পেশাব পায়খানা করা একেবারেই অবৈধ খোলা জায়গা হোক অথবা কোনো আড়ালে হোক। কিন্তু ইবনু উসাইমীন বলছেন যে, খোলা জায়গায় কিবলামুখী হয়ে পেশাব পায়খানা করা ঠিক নয় তবে কোনো আড়াল থাকলে কোন অসুবিধা নেই কিন্তু শাঈখ আলবানী এধরনের মতবিরোধের কারণে শাঈখ ইবনু উসাইমীন রহঃ কে ছোট মনে করেননি বরং তিনার জ্ঞানের প্রশংসা করে তিনি বলেছেন যে ইবনু উসাইমীন হচ্ছেন একজন বড় ধরনের যোগ্য আলেম।  

*(الإيجاز في بعض ما اختلف فيه الألباني وابن عثيمين وابن باز.. مقدمة و ص88)* 

*_সম্মানিত পাঠকবৃন্দ।_*

উপরে উল্লেখিত উদাহরণসমূহ বর্ননা করার মূল উদ্দেশ্যেই হচ্ছে যে সেখান থেকে আমাদের কিছু শিক্ষা গ্রহণ করা আর তা হলো এই যে, আমাদের মধ্যে পরস্পরে মতভেদ থাকতেই পারে এবং থাকাটা স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু এটা সবসময় মাথায় রাখতে হবে যে, এই মতভেদের কারণে আমাদের কথার মাধ্যমে বা কাজের মাধ্যমে যেন অপর পক্ষের সম্মানহানি না হয় তারা যেন কষ্ট না পায় বরং তাদের সম্মান করা উচিত আর এটাও ভাবা উচিত যে কিছু বিষয় এমনও রয়েছে যাতে কোনোরকমের মাসলাক মতবাদের কথাই আসবে না বরং সামাজিক ও মানবিক কল্যাণের জন্য হয়ে থাকে এসব বিষয়ে সব ধরনের মতভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করে যেতে হবে তা না হলে আমাদের মুসলিম জাতির মধ্যে আস্তে আস্তে ফাটল ধরে পরিশেষে বড় ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।।

*_আসুন আমরা পরস্পরের মতভেদ মতপার্থক্য ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দ্বীনের জন্য এগিয়ে আসি যাতে করে ইহকাল পরকাল সব জায়গায় আমরা সফলকাম হতে পারি আল্লাহ যেন আমাদের তৌফিক দান করেন আমিন।_*

*বিঃদ্রঃ :- ভুলত্রুটি মার্জনীয়*